কাকন রেজা
সামাজিকমাধ্যমে একটা ভিডিও রয়েছে। পুলিশ ম্যানহোলে পড়ে থাকা হাঁসের বাচ্চা উদ্ধার করছে। না, একটা নয় এমন অসংখ্য ভিডিও রয়েছে পুলিশকে নিয়ে। আর এর সবকটিই উন্নত বিশ্বের। তারা কেন উন্নত হয়েছে তার অনেকটা প্রমানই এসব ভিডিও।
এক বাচ্চা অঙ্ক মেলাতে পারছিলো না, ফোন করলো পুলিশকে। পুলিশ অফিসার এলেন ফোন পেয়ে, তিনিও অঙ্কটি মেলাতে পারলেন না। ডাকলেন আরেক সহকর্মীকে। সেই সহকর্মী এসে বাচ্চাটির অঙ্ক মিলিয়ে দিল। একজন বাচ্চাও জানে পুলিশকে ফোন দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়। এই ঘটনাটিও আমাদের দেশের নয়, প্রথম বিশ্বের একটি দেশের। দেশটির প্রথম বিশ্বে ঠাঁই পাওয়ার প্রমান সাথে কারণও এই ভিডিওটি।
বিপরীতে আমাদের দেশের চিত্র কী? আমাদের কোনো বাচ্চা যদি পুলিশকে ফোন দেয় অঙ্ক মেলানোর জন্য তবে কী হবে? সম্ভবত বাচ্চার পরিবারের উপর দিয়ে যাবে তার কাফ্ফরা। পুলিশকে অযথা হয়রানির দায়ে ভুগতে হবে তাদের। এটাই হয়তো সম্ভাব্য চিত্র। না, এর বিপরীত চিত্র যে নেই, তা বলবো না। আমাদের দেশেও ভালো চিত্র রয়েছে, রয়েছেন মানবিক পুলিশ। তাদের সংখ্যাও হয়তো অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন একজন বিসিএস দিয়ে পুলিশ প্রশাসনে আসা ব্যক্তি আটক হয়, তখন পুলিশের মানবিক চেহারাটা ম্লান হয়ে যায়। একজন ওসি প্রদীপ যখন অবসরে যাওয়া মেজরকে হত্যার নির্দেশ দিতে পারেন এবং একজন উপরিদর্শক সে নির্দেশ মেনে তাকে হত্যা করতে পারেন, এমন ঘটনা সকল মানবিকতাকে তুচ্ছ করে তোলে। ‘বাবা তুমি কাঁদছো কেন’, একজন বাচ্চার এমন ভয়ার্ত উচ্চারণও আমাদের সকল মানবিকতার বিধ্বস্ত চেহারাটাকে স্পষ্ট করে।
বাংলাদেশের পুলিশের সম্ভাবনা নেই, এমন যারা ভাবেন, তারা ভুল ভাবেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি এবং বন্ধুও আমার তারা, যারা পুলিশের অনেক উঁচু পদে আছেন, তারা অসম্ভব রকম সৎ ও মানবিক। আমার অন্তত ৪ জন পরিচিত বন্ধুজন আছেন, যারা এখন ডিআইজি পদমর্যাদার। তাদের সততা প্রশ্নাতীত। তাদের কর্মদক্ষতাও তাই। অথচ এসব কর্মকর্তাদের সকল চেষ্টা ম্লান করে দেয় উপরোল্লিখিত ঘটনা সমূহ। কদিন আগে ডাকাতির সাথেও জড়িত হয়েছে পুলিশ সদস্যদের নাম।
এসব কারণেই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, আমরা কাকে বিশ্বাস করবো। আমাদের অভয়ের জায়গাগুলোতে যদি আমরা নিরাপদ না থাকি, না ভাবি তবে আমরা যাবো কোথায়? আইন প্রয়োগ, আইন বাস্তবায়ন, দোষী নির্ধারণ এসব ব্যাপারে আজ কথা উঠছে। প্রশ্ন উঠছে। আমরা কি চাই এমন কথা বা প্রশ্ন উঠুক? অনেকে হয়তো সরকার বিরোধীতার কারনে এমনটা চান। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, যত এগুলো ঘটবে তত সরকারের উপর চাপ বাড়বে। কিন্তু বিপরীতে তারা যে আমজনতার জন্য রাজনীতি করেন, তাদের তো সেই চাপের ভার বহন করতে হবে। সরকার হয়তো চাপ সামলে নিতে পারবেন, কিন্তু আমজনতার সেই চাপ সামলানো ক্ষমতা কি রয়েছে? নেই।
কীভাবে নেই, তার একটা ঘটনা বর্ণনা করি। অপহরণ ও মুক্তিপনের অভিযোগে যেদিন এএসপি আটক হলেন সেদিনের গণমাধ্যমই সে ঘটনা জানিয়েছিলো। সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া রেলস্টেশনে একটি চায়ের দোকানের সামনে গৃহবধূকে বসিয়ে রেখে তার স্বামী গিয়েছিলেন ভ্যানের ভাড়া মেটাতে। এসে স্ত্রীকে আর পাননি। পরের দিন তার স্ত্রীকে পান স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অসুস্থ অবস্থায়। সেই স্ত্রীকে রেইপ করা হয়েছিলো, গণমাধ্যমের ভাষায় যা ‘গণধর্ষণ’। একটা রেলস্টেশনে পুলিশ থাকে, সেখানে রেলওয়ে থানাও থাকে। সেখান থেকে একজন নারীকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেইপ করা সম্ভব হলে, বাদ থাকে আর কী?
রেল স্টেশন আর রেলের অপরাধের ভিক্টিম আমি এবং আমার পরিবার স্বয়ং। আমার সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে রেল ভিত্তিক একটি অপরাধী চক্রের মাধ্যমে। যারা প্রফেশনাল খুন, অপহরণ ও ছিনতাইয়ে। যারা টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে। যাদের পেশাই খুন, ছিনতাই। আমি নিজেই খোদ ভুক্তভোগী, সাক্ষি, প্রমান সব। আমি গণমাধ্যমে আছি বলে, আমার কিছু পরিচিতি মানুষ রয়েছেন পুলিশ ও বিভিন্ন জায়গায়, তাই হয়তো আমার ছেলের লাশটা পেয়েছি। অন্য কেউ হলে হয়তো এখন পর্যন্ত লাশটাও পেতো না। জানতোও না নিখোঁজ সন্তানটি বেঁচে আছে না মরে গেছে। কবরের পাশে বসে দোয়া ও সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগটিও পেতো না।
সে কারণেই বলছি, আমরা কাকে বিশ্বাস করবো? আমাদের নির্ভর করবো কার উপর? কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হয়, এক প্রধানমন্ত্রী কতগুলো বিষয় দেখবেন? আর উনি ব্যক্তিগত ভাবে দেখবেনই বা কেন? তাহলে প্রশাসন, বাহিনী, আইন, মন্ত্রণালয় কিসের জন্য? প্রশ্ন জমে জমে কিন্তু অনেক। উত্তর পরিষ্কার না হলে, যা এক সময় বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে। কাকন রেজা লেখক ও সাংবাদিক।